নন্দিত নরকে হুমায়ুন আহমেদ স্যারের প্রথম উপন্যাস। এটি ১৯৭১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।বইয়ের নাম টা দেখেই বইটা পড়ার আগ্রহ হয়েছিল আর বইটি পড়ে একটু নিরাশ হই নাই বরং মনে হয়েছে না পড়লেই অনেক বড় একটা মিস হয়ে যেত।
নন্দিত নরকে একটি পারিবারের কাহিনি অবলম্বনে রচিত। সেই পরিবারের বিভিন্ন দুঃখ কষ্ট ও ভালো কিছু মুহুর্ত নিয়ে রচিত।কাহীনির মূল চরিএ ছিলো রাবেয়া।রাবেয়া ছিলো মানসিক ভাবে অসুস্থ, সে শারীরিক ভাবে বড় হলেও মানসিক ভাবে ছিল ছোট্ট একটা শিশুর মতো। সংসারের ভালো মন্দ বুঝার মতো তার ক্ষমতা ছিলো না।রাবেয়ারা ছিলো দুই ভাই ও দুই বোন।সবার বড়ো ছিলো রাবেয়া।এখানে হুমায়ূন আহমেদ নিজেকেই ফুটিয়ে তুলেছেন বড় ভাইয়ের ভূমিকায়।তার ডাক নাম ছিলো খোকা।রাবেয়ার পরেই ছিলেন তিনি, তার পর ছিলো মন্টু,মন্টুর পরে ছিলো রুনু।
তারা চার ভাইবোন চার ধরনের ছিল। রাবেয়া মানসিক অসুস্থ হলেও সবার অনেক আদরের ছিল। আর লেখক ছিল খুবই সচেতন এবং পরিবারের প্রতি অসীম দায়িত্বশীল। মন্টু তাদের নিজের ভাই না হলেও তারা এটা কখনও মনে করতো না। মন্টু একটু ছন্নছাড়া হলেও পরিবারের প্রতি ছিল তার অসীম টান।আর রুনু সবার ছোট ছিল তাই সে সবার আদরের ছিল। আর তাদের সংসারে আরও একজন ছিল তা হলো রাবেয়ার পোষ্য কুকুর,যে কিনা রাবেয়া এর খুব কাছের ছিল। আর তাই তো তার মৃত্যুতে রাবেয়া অনেক কষ্ট পেয়েছিল।
রাবেয়া কোনটা খারাপ আর কোনটা ভালো কিছু বুঝতো না,সব সময় ছোট দর্শি মেয়ের মতো ছোটাছুটি করতো।সে সময় রাবেয়া ছিলো ভরা যৌবনে পরিপূর্ণ। তার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাওয়ার সময় হলেও,বিয়ে হয়নি।রাবেয়ার সারা দিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেরাত।তার অনাবৃত শরীর ভুলেও যেন কারো চোখে না পড়ে,এই ভয়ে তার মা শাড়িতে দশ টা করে সেফটিপিন লাগিয়ে দিতেন।রাবেয়াকে কোনো বিষয় নিয়ে বারন করলে সে আরো বেশি করে সেই কাজটা করতো,তাই কেউ তাকে কিছু বলতো না।
রাবেয়ার বাবা ছিলো একজন স্কুল শিক্ষক, তার কলেজের এক বন্ধু যার নাম শরীফ অাকন্দ, তিনি রাবেয়াদের বাসায় থাকতেন।তিনি ছিলেন অনেক ভালো লোক,রাবেয়া ও তার ভাই বোনেরা তাকে মাস্টার কাকা বলে ডাকতেন।তিনি সব সময় আপনজনের মতোই তাদের সাথে ছিলেন এবং চার ভাইবোনকে শরীফ আকন্দ হাতেখড়ি দিয়ে গড়ে তুলেন।কখনো কেউ বুঝতে পারতো না শরিফ তাদের নিজের কেউ ছিলো না।
তাদের দিন মোটামুটি ভালোই যাচ্ছিলো।হঠাৎ একদিন তাদের পাশের বাসায় নতুন লোক আছে,যেখানে শিলু নামের এক মেয়ে ছিলো,তার প্রেমে পড়েছিলো লেখক।আর শিলুর এক ভাই ছিলো যার নাম ছিলো হারুন।হারুন রাবেয়াকে ভালোবেসে ফেলে,এই কথা হারুনের বাড়িতে শুনাশুনি হলে হারুনের মা তাদের বাসায় এছে খুব বকাবকি করে।এতে রাবেয়ার বাবা রাবেয়াকে খুব মারে।যদিও রাবেয়া জানতোই না ভালোবাসা কি।এদিকে হারুনের বিয়ে হয়ে যায় তার খালাতো বোন নাহার এর সাথে।বিয়ে করে সপ্তাহ খানেক পরে তিনি বিদেশ চলে যান।রাবেয়া সংসারের এই সব কিছু বুঝতে না পারলেও তাকে এই সমাজ ছাড় দেয় নাই।আর তাই এই ফুলের মতো নিষ্পাপ মনের এই রাবেয়া কেউ অন্যের কটু কথার জন্য বাবার মার খেতে হয়েছিল।
হারুন বিয়ের পর বিদেশে চলে গেলে তাদের দিনকাল আবার ভালো ভাবে যেতে লাগলো।তারা পুনরায় শিলুদের বাড়িতে যায়,রাবেয়া আগের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াতো। হঠাৎ একদিন রাবেয়াকে খুজে পাওয়া যায়না।সবাই খুব চিন্তায় পড়ে যায়।রাত আটটার সময় শরিফ কাকা রাবেয়াকে নিয়ে বাড়িতে আসে।বলে স্কুলের কাছে নাকি তাকে পেয়েছে।যাই হোক এতে করে সবাই চিন্তা মূক্ত হয়।
এর মধ্যে খোকা মানে লেখক লক্ষ করে তার মা বাবা কোনো বিষয় নিয়ে আলোচানা করে।মাঝে মাঝে বাবা খুব রাগান্বিত হয়। তার মা চুপ চুপ করে কান্না করে।লেখক মায়ের কাছে কান্নার কারন জানতে চাইলে তিনি কিছুই বলেন না শুধু নিরবে তা এড়িয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন সংসারে কোন সমস্যা হয়েছে কিন্তু কি সেই সমস্যা তা বুঝতে পারেন না।
কয়েক দিন পর রাবেয়াকে নিয়ে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যায়।এতে ধরা পড়ে রাবেয়ার জীবনের ঘটে যাওয়া অঘটন।রাবেয়ার মতো অবুঝ,সংসারে কিছু বুঝতে না পারা নিষ্পাপ মেয়েটাকেও কোনো এক অমানুষ ছাড়েনি।রাবেয়া ছিলো গর্ভবতী। এ নিয়ে সবাই খুব চিন্তায় পড়ে যায়।তার মা তার কাছ থেকে সেই লোকটার কথা জানতে চাইলে রাবেয়া কিছুই বলতে পারে না,কারন সে তো ও সবের কিছুই বুঝতে পারে না তাহলে বলবে কি ভাবে।
রাতে রাবেয়ার মা হুমায়ূনকে ডাকে,খোকা এ ঘরে আছো,গিয়ে দেখে পুরো ঘর রক্তে লাল।খোকা বলে এ কি মা,তোমরা কি রাবেয়াকে কিছু খাইয়েছো??রাবেয়ার বাবা কান্না করে বলে তারাতারি ডাক্তার ডাকো।ডাক্তার এসে রাবেয়াকে ইনজেকশন দেয়,আর কিছু ঔষধ দেন।তাতেও কিছু হয়না।রাবেয়া বার বার বলতে থাকে মা আমার বুকটা কেনো ফাকা ফাকা লাগতেছে। তার মা বলে চুপ করে থাকো মা একটু পর ঠিক হয়ে যাবে।অবস্থা খারাপ দেখে মন্টু কে তার বাবা শহর থেকে বড়ো ডাক্তার আনতে বলে।শরিফ কাকা বলে আমি যাচ্ছি ডাক্তার আনতে।এই বলে সাইকেল নিয়ে শহরে যায়।
রাত পার হয়ে সকাল হয়,রাবেয়া থেকে থেকে বলে ওঠে মা আমার বুকটা খালি খালি কেনো লাগতেছে।খোকাকে বলে খোকা পলা আমায় ডাকতেছে।পলা ছিলো তাদের পালিতো কুকুর,যে ছিলো রাবেয়ার অনেক কাছের সঙ্গি।পলা অনেক দিন আগে মরে যায়। সকাল নয়টা পর্যন্ত এভাবে যাওয়ার পর রাবেয়া তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।পরে থাকে রাবেয়ার নিথর দেহ।
এরই মধ্যে মিন্টু সবটা বুঝতে পারে যে, কেন তার নিষ্পাপ বোনটাকে আজ এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো।তাই তো শরিফ কাকা ডাক্তার নিয়ে এলে,মন্টু কোন কিছু না বলে মাছ কাটা বটি দিয়ে শরিফ কাকাকে কুপিয়ে তিন ভাগ করে।এর পুলিশ এসে মন্টুকে নিয়ে যায়।পুলিশ মন্টুকে অনেক বার জিজ্ঞেস করে কেনো শরিফকে মারছে,কিন্তুু মন্টু কিছুই বলে না।কারণ সে কোন ভাবেই মৃত্যু বোনের অসম্মান করতে চায় নি কিন্তু লেখক তা ঠিকই বুঝতে পারে।অনেক কিছু করেও মন্টুকে ছাড়ানো যায় না এবং কিছুদিন পর মন্টুর ফাঁসির অর্ডার হয়।এবং যেদিন মন্টু এর ফাঁসি হয় আমার নিজের বুকটাই কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
বইয়ে আরও ছোট ছোট অনেক ঘটনা রয়েছে সেগুলো জানতে হলে বইটা পড়তে হবে। আমাদের সমাজে শরিফ কাকার মতো অনেক লোক আছে যারা ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকলেও ভিতর থেকে তারা পুরোপুরি কলুষিত। বইটা পড়ে নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেলেছি আর আমাদের দেশের এরকম হাজারো মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে এর মিল খুঁজে পেয়েছি।এক কথায় অসাধারণ একটা বই।
ধন্যবাদ
0 Comments