বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ব্রাজিলিয়ান এ লেখকের সর্বাধিক জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম হচ্ছে “দ্য আলকেমিস্ট”। বইটি আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছি আর অসাধারণ একটা অনুভুতি কাজ করেছে।এখন বইটির সম্পর্কে সংক্ষেপে একটু কিছু লেখার চেষ্টা করছি।
উপন্যাসের নায়ক এক কিশোর। স্পেনের আন্দালুসিয়ায় তার বাস। একটু বড় হবার পর সে চাইল ভ্রমণে বের হবে।ঘুরে বেড়ানোর জন্য যথেষ্ট টাকা তার বাবা বা তার ছিল না।তাই তার বাবা বলল, ঘুরে বেড়ানোর জন্য মেষপালক/রাখাল হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিছু ভেড়া কিনে সে হয়ে গেল মেষপালক। তার ভেড়ার পাল নিয়ে সে ঘুরে বেড়াতে লাগল এখান থেকে সেখানে। ভেড়ার সাথে থাকতে থাকতে একসময় সে তাদের ভাষা বুঝতে পারে- তাদের চাহিদা, অভাব, অভিযোগ সে উপলদ্ধি করে। বিনিময়ে সে পায় ধৈর্য্যের শিক্ষা।
একদিন সে ভেড়ার লোম বিক্রি করতে গিয়ে সেই বনিকের মেয়ের সাথে আলাপ হয় সেই রাখালের।পরে সে যখন সেখান থেকে চলে যায় সে মেয়েটিকে খুব মিস করতে শুরু করে।তাই সে আবার সেই বনিকের মেয়ের সাথে দেখা করতে আসতে চায়।আর তখন তার সময় কাটে কিছুদিন আগেই পরিচয় হওয়া ব্যবসায়ীর কন্যাকে নতুন কি গল্প শোনাবে তার চিন্তার আর স্বপ্নিল চোখে সমুদ্রের অপর পাড়ের মূর দেশের দিকে চেয়ে। স্পেনের উপকূল থেকে জাহাজে মাত্র দু’ ঘন্টার পথ। অথচ তার মতো আর কোন মেষপালকই ওখানে যাবার ইচ্ছা করেনি।
হঠাৎ করে একদিন সে স্বপ্ন দেখে গুপ্তধনের।সে প্রথমে তার স্বপ্নকে বিশ্বাস করে নি।কিন্তু পরে সে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে নিজের স্বপ্নকে বিশ্বাস করে।এরপর থেকে তার ছুটে চলা শুরু হয় সেই গুপ্তধনের রহস্যের সন্ধানে। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কিশোর যায় অচেনা মূর দেশে। স্পেনে আরব মুসলমানদের মূর নামেই ডাকা হয়। এক সময়কার স্পেন বিজয়ী মুসলমানরা এসেছিল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আরব দেশ হতে। সেখান থেকে সমুদ্রের উপর দিয়ে যে বাতাস আসে তাকে তারা বলে ল্যাভানটার। সে আরেক গল্প এখন আর সেটা নিয়ে না লিখি।
সদ্য আরবে এসে এক ঠগবাজের কাছে অভিযানের জন্য জমানো সব সম্পদ খুইয়ে ফেলে। এরপর সে কাজ নেয় এক ক্রিস্টালের দোকানের কর্মচারী হিসেবে। পরিশ্রমী, ধৈর্য্যশীল এই কিশোর সেখানেও তার বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা দিয়ে চমক লাগিয়ে দেয়।এক বছর পরিশ্রম করে সে যে সম্পদ হারিয়েছিল তার চেয়েও বেশি সম্পদ অর্জন করলো।তখন সে আবার তার দেশে ফিরে গিয়ে মেষ কিনে আগের জীবনে ফিরে যেতে চাইলো।
কিন্তু সেখানে আবার তার গুপ্তধন পাওয়ার স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের কারনে।আর তাই সে তার সমৃদ্ধির জীবন ছেড়ে সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দেয় দুর্গম সাহারা মরুভূমি।পৌঁছে এক মরুদ্যানে। আর এই যাত্রা পথে তার পরিচয় হয় এক ইংলিশ মেনের সঙ্গেও।তার কাছে এবং এই যাত্রা থেকে সে অনেক কিছু শেখে।তার তাই সে প্রকৃতির ইশারায় শান্ত, নিরাপদ মরুদ্যানকে বাঁচিয়ে দেয় ভয়ানক শত্রুর আক্রমন থেকে।পরিচয় হয় ফাতেমা নামের বেদুঈন কন্যার সাথে।প্রথম দেখায় সে তাকে ভালোবেসে ফেলে।এর পর তাদের প্রনয় হয়ে যায়।এবং তাকে ছেড়ে সে গুপ্তধনের সন্ধানে যেতে চায় না।তখন সে তাকে বলে বেদুঈন মেয়েরা তাদের স্বামীর জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করে থাকে। সুতরাং, সে যেনো পিছুটান ভুলে গুপ্তধনের সন্ধানে বের হয়।তখন সে আবার সাহস পায় তার এই যাত্রায়।
এই মরুদ্যানেই সে দেখা পায় অ্যালকেমিস্ট নামের এক ব্যক্তির।অ্যালকেমিস্ট হলো এক রহস্যময় ব্যক্তি যে লোহাকে স্বর্ণে রূপান্তর করতে পারে।যে জানে মহাবিশ্বের ভাষা। ইংলিশম্যান তার সন্ধানে বছরের পর বছর ঘুরে ফেরে। লোকে বলে তার বয়স নাকি দু’শো বছর। কিশোর নায়কের লক্ষ্যের প্রতি দৃঢ় মনোবল, প্রতিজ্ঞা অ্যালকেমিস্টকে মুগ্ধ করে।এই দীর্ঘ যাত্রায় অ্যালকেমিস্ট তাকে প্রত্যেক পদে পদে সাহায্য করে। কিশোরকে পথ দেখিয়ে সেই পৌঁছে দেয় পিরামিডের কাছে।
কিশোর এগিয়ে যায়। পথে পথে আক্রান্ত হয়। এরপরও সে থামেনি। প্রকৃতির ইশারা থেকে ঠিক করে নেয় যাত্রাপথ। তবুও স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা এই কিশোর কখনো বিচ্যুত হয়নি তার বিশ্বাস থেকে। সে জানত তার গুপ্তধনের সন্ধান সে পাবেই। এসকল বাধা-বিপত্তি তাকে সাহস জুগিয়েছে। মরুভূমির নির্জনতা, বাতাসের মুখরতা আর ভেড়ার পালের অপরিসীম ধৈর্য্য তাকে শিখিয়েছে মহাবিশ্বের ভাষা। সে ভাষায় সে কথা বলেছে আকাশের সাথে, সূর্যের সাথে। নিজেকে পরিণত করেছে প্রচন্ড ঝড় সাইমুমে। এসকল কাজে তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে রহস্যময় আলকেমিস্ট।
দীর্ঘ উত্থান আর পতনের পর কিশোর ঠিকই তার গুপ্তধন খুঁজে পায়। তার লক্ষ্যে সে ঠিকই পৌঁছে। কিন্তু এ পরিশ্রম আর কষ্ট কিন্তু তাকে গুপ্তধনের চাইতেও অনেক অনেক বড় জিনিস উপহার দেয়। তা হলো জীবনের গুঢ় রহস্য- মহাবিশ্বের ভাষা বোঝার ক্ষমতা। যে ভাষায় স্রষ্টা আর সৃষ্টির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত। যে ভাষা বুঝলে সৃষ্টি বুঝে যায় তার স্রষ্টার উদ্দেশ্য।
অসাধারণ একটা বই।যারা নিজের লক্ষ্য নিয়ে এখনো দ্বিধা দ্বন্দে আছেন তাদের সকালের এই বই পড়া উচিৎ। এখানে একটা কথা আমার খুব ভালো লাগছে তা হলে আমরা যদি কোন কিছু মন থেকে চাই তাহলে সমগ্র সৃষ্টি তা আমাদের দেওয়ার জন্য সাহায্য করে। এই দুঃসাহসি রাখাল ছেলে সান্তিয়াগো অনেক উত্থান পতনের সম্মুখীন হয়েছেন।কিন্তু তিনি তার মনের কথা শুনেছেন।এবং সাহস নিয়ে নিজের স্বপ্নের পথে হেঁটেছেন আর তাই শেষ অবধি পৌঁছে গেছেন সেখানে।
এখানে ভালোবাসার যে একটা শক্তি আছে সেটা আমার খুব ভালো লেগেছে।কোন কারনে আমরা কষ্ট পেতে পারি এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।আর এই কষ্টকে কি ভাবে শক্তিতে পরিনত করা যায় সেটাও বুঝেছি।তাই নিজের মনের কথা বুঝতে শিখতে হবে।
0 Comments