Recents in Beach

দেবদাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটা ট্রাজেটি উপন্যাস।এবং আমার পড়া প্রথম প্রেমের উপন্যাস। বইটা আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত হয়ে পড়েছিলাম আর পড়তে পড়তে কখন যেন নিজের অজান্তেই চোখের কোনে পানি এসে গেছিল।

উপন্যাসটির সবচেয়ে মধুর দিনগুলো ছিল তাদের বাল্যকাল,যখন তারা মণকষার অঙ্ক শিখতে থাকলেও দূরে ছিল জীবনের নানা হিসাব-নিকাশ থেকেই।সম্পর্ককে কোনোকিছুর মাপে পরিমাপ করতে শেখেনি তখনো। পাঠশালায় পড়তে গিয়ে দেবদাসের পড়ায় ফাঁকি, পালিয়ে যাওয়া, লুকিয়ে থাকা এসবকিছুর সময়ই তার একজন সঙ্গী ছিল। সে পার্বতী,শুধুই পার্বতী।আর তাকে খুঁজে পাওয়া না গেলে একমাত্র পার্বতীয় তাকে খুঁজে বের করতে পারতো।এখানে দেখা মেলে ধর্মদাসেরও, দেবদাসের আরেক চির শুভাকাঙ্ক্ষী। দেবদাস আর পার্বতীর জন্য অনুকূল এক ব্যক্তি। দুষ্টুমি করে পালিয়ে যাবার পর পার্বতী খাবার লুকিয়ে নিয়ে যায় তার দেবদার জন্য। এরপরও সুযোগ পেলেই সেই পারুকেই মারতো দেবদাস। এ যেন তার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার আরেক ছল। তবু বড় সহজ এই সম্পর্ক। জটিলতার কিছুই চেনে না। মারামারি আর বিভিন্ন খুনসুটির মাধ্যমেই তাদের দিন কেটে যায়।তাদের ছোট বেলা টা পড়তে আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিল।
রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে সারাদিন একসাথে ঘুরে বেড়ানো, সকল ফন্দি-ফিকিরের সমান ভাগীদার।একজন দুঃখ দেয়, অপরজন হাসিমুখে তা মেনে নেয়। এই দুঃখ তার কাছে সকল সুখের চেয়ে বেশি দামি বলেই মনে হয়। যে দুঃখ দেয়, তার দুঃখ যেন অপরজনের চেয়েও বেশি। এমনই সহজ হিসেবে কেটে যায় তাদের দিনগুলো, যতটা নিজের জন্য, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি অপরজনের জন্য।তাদের দিন গুলো এভাবেই কেটে যেতে পারতো কিন্তু তা আর কাটলো না।তাদেরও বিচ্ছেদ ঘণ্টা বাজতেছে সেই ছোট দুই অবুঝ মন বুঝতেই পারে নি।
দেবদাসকে পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে দেয়া হয় কলকাতা শহরে,আর তার নিত্যদিনের সঙ্গী পারু রয়ে যায় সেই গ্রামেই।দেবদাসের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোকে পুঁজি করে কাটে পারুর দিন, আর তার দেবদা হয়তো মিশে গিয়েছে আজ শহরের আলোয়। শীঘ্রই বাড়ি না ফেরত পাঠালে সে পালিয়ে আসবে- এমনটাই বলে গিয়েছিলো পারুকে। কিন্তু হায়! সে পণও বুঝি ভাঙলো। চিঠির অপেক্ষা আর চিঠি লেখা,এ দুই-ই হয়ে ওঠে পারুর দিনাতিপাতের উপায়।একটা মেয়ে নিজের মনের কথাটা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে একটা ছেলে হয়তো সেটা এত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে না।পারুর অপেক্ষার এই দিন গুলো যখন পড়ছিলাম তখন বার বার তাই মনে হচ্ছিল।
এমন করে একদিন পার্বতী আবার পাঠশালায় যেতে চাইলো, সে-ও পড়াশোনা করতে লাগলো। অভ্যেসের পরিবর্তন হলেও স্মৃতিকাতরতা তাকে কখনোই ছাড়েনি। গ্রীষ্মের ছুটি হয়, দেবদাস বাড়ি আসে। অনেক কথা হয়, অনেক সময় কাটানোও হয়। তবু কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে আগেকার দিন! কেউই নেই আগের মতো,দেবদাস বদলে গিয়েছে একটু বেশিই।এই পরিবর্তন পারুকেই বেশি কষ্ট দিয়েছে সেটা বই পড়লেই অনুভব করা যায়।
পরেরবার গ্রীষ্মের ছুটিতে দেবদাস বাড়ি আসেনি। বিদেশ বেড়াতে গিয়েছিল। তাই এবার পিতামাতার বহু জেদের ফলে তার আগমন ঘটলো। আগমনের দিন পারুর সাথে দেখা হলো না,সেও এলো না।কারন দেবদাস এতদিনে পারুকে তেমন কোন চিঠি দেয় নি আর তাই পারুর অভিমান তখন তুঙ্গে ছিল।পরের দিন যখন পারুদের বাড়ি গেল, সবকিছু যেন নতুন রূপে তার সামনে ধরা দিলো। আগের সহজতা কেটে গিয়ে এসেছে রহস্যের চেহারা। দুজনের মাঝেই লজ্জামাখা এক অনুভূতি তাতে চোখাচোখি যত হয়, কথা ততটা জমে না। একে অপরকে বিস্ময়ের চোখে দূর থেকে দেখে আর, নিজেদের ছোটবেলার সঙ্গীকে মিলাতে থাকে।
পারু যে দেবদাস কে ভালোবাসিয়া ফেলেছিল তা পারুর মা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল।ঘটনাক্রমে দেবদাসের সাথে পারুর বিয়ের কথা ওঠে। প্রস্তাবটা আসে পারুর মায়ের কাছ থেকেই। কিন্তু জমিদারবাড়ির সাথে বুঝি ঠিক মিলটি হলো না,সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলো।এতে করে দুই পরিবারের এত বছরের সেই মধুর সম্পর্কের মধ্যেও ফাটল ধরলো।আর পারুর মা ও পারুকে উচ্চ ঘরে বিয়ে দেওয়ার পণ করে বসলো।
কিন্তু এত কিছুর পরও মনে মনে দেবদাসকেই বর হিসেবে গ্রহণ করা পার্বতী যেন নিজের মধ্যে সকল কষ্ট সয়ে যেতে থাকে।সই মনোরমার কাছে সে একথা স্বীকার করে।এও বুঝতে পারে যে দেবদাস তাকে বিয়ে করবে কিনা এই প্রশ্ন তাকে নিজেকেই জিজ্ঞেস করতে হব।এখানে এসে পার্বতীর চরিত্রের দৃঢ়তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়।এখনের যুগেও মেয়েরা এমন পদক্ষেপ নিতে গেলে হাজারবার ভাববে, কিন্তু শরৎচন্দ্রের পার্বতী সে দ্বিধায় ভোগেনি।
আর তাই তো গভীর রাতে সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে মানসম্মান এর ভয় না করে দেবদার ঘরে যায় পার্বতী। তার এই সাহসই বুঝিয়ে দেয় দেবদাসের প্রতি তার প্রেমের গাঢ়তা। দেবদাস চমকে যায়। পার্বতী কেন এভাবে এসেছে তার চাইতেও তার কাছে বড় হয়ে ওঠে সম্মানের ব্যাপারটি। পার্বতীর বদনাম যাতে না ঘটে এজন্যই হয়তো তার এই দুর্ভাবনা।সেদিন রাতে আবার পার্বতীকে বাড়ি পৌঁছে দেয় দেবদাস।দেবদাস এর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে সেদিন রাতে ফিরে আসে পারু।
এরপর দেবদাসও পারুকে কিছু না জানিয়েই শহরে চলে গেলো।পারুর মুখামুখি হবার সাহস আর বাকি ছিল না তার মধ্যে। সেখান থেকে একটা চিঠি পাঠালো, যাতে লেখা ছিলো পারু যেন তাকে ভুলে যায়। দেবদাসের চরিত্রের দুর্বলতা প্রথমবার প্রকাশ পায়, এবং এজন্যই প্রেমের গল্পটি মিলনের না হয়ে চির বিরহের খাতায় নাম লেখায়।দেবদাস পরিবারের চাপে বা নিজের অজ্ঞাতায় হউক পারুর প্রতি তার ভালেবাসাটা বুঝতেই পারলো না।
স্বাভাবিকভাবেই চিঠি পেয়ে পার্বতী ভেঙে পড়ে। কিন্তু আত্মসম্মান রক্ষার জন্যই তার মধ্যে দেবদাসের জন্য জন্ম নেয় ক্ষোভ। ভালোবাসার মানুষটির জন্য সকল অপমান সহ্য করা যায়, কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় অপমানটি যখন তার কাছ থেকেই আসে,তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। পারুরও তা-ই হয়!
দেবদাস তার ভুল বুঝতে পারে, তবে কিছুটা দেরিতে।সে আবার বাড়ি ফিরে আসে।কিন্তু হায় ততদিনে পারুর সম্মতিতেই বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে তার।এমন কি পারু দেবদাসের সাথে দেখা পর্যন্ত করার সম্মত ছিল না। অধিক শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল সে।অনেক চেষ্টা করেও দেবদাস কিছুদিন পারুর সাথে দেখা করতে পারলো না। একদিন,পুকুরঘাটে দেখা মিললো পার্বতীর।পূর্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েও পাথর হয়ে যাওয়া পার্বতীর রুক্ষতা দূর হলো না।এবার বিয়ের প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যান এলো অপরপক্ষ থেকেই।
এর পর পারুর বিবাহ সুসম্পন্ন হলো অন্য কোন জমিদারের সাথে।এরপর দুজনেই ফিরে গেলো দুজনার গন্তব্যে,সঙ্গী থেকেও সঙ্গীবিহীন জীবনে।
আত্মগ্লানি আর বিরহে দেবদাস বেছে নিলো চুনিবাবুর সঙ্গ। চুনিবাবুর সাথে গিয়ে দেখা মিললো চন্দ্রমুখীর।চন্দ্রমুখী হলো এই ত্রিভুজ প্রেমের আরেকটি অংশ। পেশায় বাইজী। সকলের মনোরঞ্জন করা তার কাজ, তবু স্বীয় ব্যক্তিত্বে সে প্রচন্ড প্রবল। এই প্রবলতা দেবদাসকে ছুঁতেও পারলো না, নাকি অনেকখানি ছুঁয়ে দিলো? প্রথম দেখা থেকেই চন্দ্রমুখীর মন জুড়ে রইলো দেবদাস। নিজের সর্বস্ব যেন বিনা ঘোষণায় সে সঁপে দিল দেবদাসের চরণে।
সারা দিনরাত মদ্যপানে ডুবে গেলো দেবদাস, চন্দ্রমুখী বা চুনিলাল কেউই তাকে ফেরাতে পারেনি। কী করে পারবে?এ ডুবে থাকা যে অন্য কারো জন্য। আজো সে শুধু পার্বতী! চন্দ্রমখী দেবদাসের এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারতো না।এই দিকে দেবদাসও একে একে তার জমিদারি শেষ করতে থাকে।
এই দিকে বয়স্ক স্বামীর দ্বিতীয়া স্ত্রী হয়ে ঘরকন্যা সামলাতে লাগলো পার্বতী। এ ক’দিনেই তার মধ্যে এসে পড়েছে অদ্ভুত পরিপক্বতা! ভুবন চৌধুরীর জমিদারবাড়িতে পার্বতীই করত্রী, তাকে তো পরিপক্ব হতেই হবে। সে যে আর তার দেবদার খেলার সাথী নয়, আজ সে জমিদারগিন্নী! সৎ ছেলে-মেয়ে সবার মন জয় করে নিলো পারু। তার সংসার বেশ ভালোই চলতে লাগলো। তবু মাঝে মাঝে আরশিতে এই সোনার মুখে চাঁদের সেই কলঙ্ক দেখে চোখ ভেজে কি? হয়তো ভেজে।
চন্দ্রমুখীই এখন দেবদাসের নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু জ্ঞানত তার কাছে দেবদাস আসতে পারে না। মাতাল না হলে এখানে সে পা ফেলতে পারে না। মদ্যপানে বারণ করলে দেবদাস সে কথা শোনে না।একদিন এই মাতাল অবস্থায় দেবদাস জানতে পারে যে তার বাবা মারা যায়।সে সময় পারুও আসে।এবং দেবদাসের সাথে তার দেখা হয়। এবং সে দেবদাসের কাছে কথা নেয় সে যেন তার বাড়িতে যায় এবং তাকে তার সেবা করার সুযোগ দেয়।
আবারও দেবদাস শয়নে-স্বপনে-আধো জাগরণে সে মদের নেশায় চুর হয়ে থাকে, চন্দ্রমুখীকে ‘সহ্য’ করে। চন্দ্রমুখী নিঃস্বার্থ বন্ধুর মতো তার সঙ্গ দিয়ে যায়।ত্রিভুজ প্রেমের এই গল্পে চন্দ্রমুখী সবসময়ই ফাঁকির খাতায় থেকেছে। দেবদাসের সঙ্গ পেয়েও সে কখনো তার জন্য ‘একমাত্র’ কিংবা ‘প্রথম’ হতে পারেনি। ওদিকে পারু আর দেবদাস স্মৃতিময় প্রেমে এতটাই আচ্ছাদিত যে দূরত্ব, সামাজিক বন্ধন কিছুই তাদের মন থেকে সেই চিরপ্রেমের অনুভূতি সরাতে পারেনি। তবু চন্দ্রমুখী নিজেকে দেবদাসের কাছে সঁপে দিয়ে শুদ্ধ হয়েছে। তার মনে হয়েছে একজন বাইজীর জীবনে এটাই সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।
এরমধ্যে দেবদাসের শরীর অনেক খারাপ হয়ে যায় এবং সে বুঝতে পারে তার আর বেশি সময় নাই।আর তাই তো সে তার কথা রক্ষা করতে পারবর্তী এর বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়।কিন্তু শেষ রক্ষাটা আর হলো না।আর সে পারবর্তী এর বাড়ির সামনেই তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এই অংশের করুন বর্ননা আসলে লিখে প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাই বইটা পড়তে হবে।
এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো গভীরতায় অতল, প্রেমে অসীম,বিরহে প্রচণ্ড কাতর। উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মধ্যবিত্ত হিন্দুসমাজের সংস্কার, প্রথা আঁকড়ে ধরার রীতি এবং সেইসাথে বিলেতি কায়দার প্রতি একধরনের আকর্ষণ, জমিদারদের বাইজী নাচের প্রতি দুর্বলতা সব মিলিয়ে ‘দেবদাস’ উপন্যাসটি একটি স্পষ্ট ছবি দেওয়ার চেষ্টা তখনকার সময় ও সমাজ সম্পর্কে। সংস্কারের প্রাচীন দেয়াল ভেঙে অসম প্রেম মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও তাকে চাপা পড়তে হয় পরম্পরার বোঝার নিচে। ভাগ্যে লেখা থাকে শুধুই বিরহ ও স্মৃতিকাতরতা।
ধন্যবাদ



Post a Comment

0 Comments